কাছ থেকে দেখা সেই ছোট্ট একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ
“স্বাতী’বৌদি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’কে ছেড়ে দু’মাস সিডনী’তে থাকতে চেয়েছিলেন !”
শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর ৮৫তম জন্মদিনে – কাছ থেকে দেখা সেই ছোট্ট একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ !
না না গাঁজাখুরি গপ্পো নয় একেবারে সত্যি ! “দিন ক্ষণ স্থান কাল পাত্র” সব বলে দিচ্ছি মিলিয়ে নিতে পারেন !
– ৯ই জুলাই ২০০১, রাত সাড়ে এগারো’টা
– সিডনী’র ক্রয়ডন পার্কের একটি বঙ্গ-ভবন
– শ্রীমতী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় এবং গার্গী মুখার্জী
হঠাৎ করে গিন্নীর ডাক “এই শুনছো ? এক্ষুনি একবার ওপরে এসো” ! আমি তো জমাটি আড্ডার আসর ছেড়ে ধড়মড় করে অনেকগুলো সিঁড়ি একসাথে ভেঙ্গে ওপরের ঘরে পৌঁছোলাম ! দেখি স্বাতী বৌদি থমথমে মুখে খাটের ওপর বসে রয়েছেন আর গার্গী ওনাকে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছে ! আমাকে দেখেই স্বাতী’বৌদি উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে এসে বললেন
“ শ্রীমন্ত তোমাদের একটা অনুরোধ করব ? ”
স্বাতী’বৌদির অনুরোধ ?
তাও আবার আমাদের কাছে ?
আমি কৃতজ্ঞচিত্তে কৃতার্থ এবং উৎফুল্ল হয়ে বললাম
“ বৌদি আপনি দয়া করে অনুরোধ করবেন না !আদেশ করুন ! যা বলবেন শিরোধার্য্য ! আপ্রাণ চেষ্টা করব ! ”
শিশুসুলভ সারল্য নিয়ে অভিমানী গলায় স্বাতী’বৌদি বললেন
“গার্গী, শ্রীমন্ত তোমরা আমাকে তোমাদের এই বাড়ীতে আরো দু’মাস থাকতে দেবে ! খরচাপাতি যা হয় আমি দিয়ে দেবো ! তোমাদের সুনীল’দা কাল দুুপুরের ফ্লাইট ধরে কলকাতায় ফিরে যাক ” !
গার্গী আর আমি হতভম্ব, বজ্রাহত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় কয়েক মুহুর্ত দুজনে দুজনে‘র দিকে তাকিয়ে রইলাম ! তারপর আমার মাথায় কি খেলল কে জানে আমি বললাম
“বৌদি এতো আমাদের পরম সৌভাগ্য ! আপনি যতদিন খুশী আমাদের কাছে থাকুন ! কিন্তু সুনীল’দা ? ওনার একা একা থাকতে অসুবিধা হবে না আপনাকে ছেড়ে ?”
একটা আরোপিত তাচ্ছিল্য আর উদাসীনতা দেখিয়ে স্বাতী’বৌদি বললেন
“ না ! কোন অসুবিধা হবে না ওর ! আমি কাছে থাকা না থাকা সমান ! আমার একটাও কথা শোনে না !
কাল দুপুর এগারোটায় ফ্লাইট ~ সে খেয়াল আছে তার ?”
ব্যস এইবার ভেঙ্গে পড়ল সংযমের সমস্ত দেয়াল আর আমরা প্রত্যক্ষ করলাম এক দুশ্চিন্তাগ্রস্থ জীবনসঙ্গিনীকে যিনি তাঁর পাখনা দিয়ে সব সময় সযত্নে আড়াল করে রাখেন তাঁর প্রাণপ্রিয় সুনীল’কে !
মুহুর্তের মধ্যে পুরো চিত্রটা আমার কাছে জলের মতো পরিস্কার হয়ে গেল ! আমার প্রচন্ড অপরাধবোধ হলো ! সত্যিই তো ! আমরা কি অবিবেচক ! ধীর পায়ে একতলায় নেমে এসে জমে ওঠা আসর মাটি করে সুনীল’দাকে নিয়ে চলে এলাম ওপরের ঘরে ! সপেঁ দিলাম স্বাতী’বৌদির হাতে !
ক্ষমা করে দেবেন স্বাতী’বৌদি ~ ক্ষমা করে দেবেন সেদিনের আড্ডার সাহিত্যপ্রেমী সুনীলভক্ত বন্ধুগণ !
?????
এইরে কাহিনী শেষ কিন্তু ভূমিকাই বাদ পড়ে গেছে ! আর ধোঁয়াশা থেকে গেছে স্বাতী’বৌদির রাগ অভিমানের কারণ ! শুনুন একটু ফ্ল্যাশব্যাকে ~
২০০১ সালে আনন্দধারা’র আমন্ত্রণে এবং ব্যবস্থাপনায় সুনীল’দা সস্ত্রীক অষ্ট্রেলিয়া সফরে প্রায় তিন সপ্তাহের ও বেশী সময় কাটিয়েছিলেন সিডনী, মেলবোর্ণ এবং ক্যানবেরা মিলিয়ে !
সেদিন ছিল শেষ রজনী ওনাদের অষ্ট্রেলীয়া সফরের ! পরের দিন দুপুর এগারোটায় ফ্লাইট ! আগের সন্ধ্যায় আমাদের সকলের মন খারাপ ! তার মধ্যেই আমাদের বাড়ীর একতলায় আড্ডা জমে উঠেছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’কে মধ্যমণি করে ! ডিনারে’র পরেও আড্ডাতে ইতি পড়ার কোন লক্ষণই নেই ! আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি আর
সুনীল’দা শোনাচ্ছেন ~
“ জানো তো সত্তরের দশকে নকশাল আমলে আমি রাত করে বাড়ী ফেরায় উৎকণ্ঠা আর দুশ্চিন্তায় উন্মাদ স্বাতী আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুল একদিন সাংঘাতিকভাবে কামড়ে ধরেছিল ! আমি ছাড়াতে পারি না ! শেষ কালে বোঝালাম যে আমার বুড়ো আঙ্গুল কাটা গেলে আমি লিখব কি করে ? আমরা খাবো কি ? তবে স্বাতী ছেড়েছিল ! হাঃ হাঃ ”
এই রকম একের পর এক গল্পের মাঝে স্বাতী’বৌদি দোতলার ঘরে স্যুটকেস প্যাকিং করতে করতেও সিঁড়ি দিয়ে নেমে অন্ততঃ পাঁচবার তাগাদা দিয়ে গেছেন “ সুনীল কাল সকাল এগারোটায় ফ্লাইট ! ভোরবেলা বেরোতে হবে ! এখন শুয়ে পড় ” ! কে কার কথা শোনে ! শেষে সকলের ওপর অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হতাশ হয়ে বললেন “ আমার কথা শুনবে কেন ! তোমরা থাকো তোমাদের ফেমাস সুনীল’দাকে নিয়ে আমি নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নেব ” এই বলে গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় চলে গেলেন !
সুনীলসাগরে মজ্জিত আমাদের তখনও টনক নড়েনি – নড়ল গিন্নীর হাঁকে ! তার পরের কাহিনী তো আগেই বলেছি !
ভুলত্রুটী ক্ষমা করে দেবেন !
প্রণাম সুনীল’দা প্রণাম স্বাতী’বৌদি !
শ্রীমন্ত মুখার্জী
৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৯, সিডনী
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.